"আমার কিছু স্বপ্ন আছে। আমার পরিবার এবং বন্ধুদের একটি বিশাল বৃত্ত রয়েছে। জীবনটা ভারী সুন্দর। আমরা যখন মরে যাব, তখন কী ঘটছিল সে সম্পর্কে কেউ কিছুই জানবে না। দয়া করে আমি যা বলছি তা লিখে রাখুন। আমি আমার কথা পুরো বিশ্বকে জানাতে চাই। কারণ আমি কেবল একটি সংখ্যা নই,” বলেছিলেন ফরিদা। গাজা সিটির বাসিন্দা বছর ২৬-এর ফরিদা ইংরেজি পড়ান। অক্টোবরে তিনি তাঁর প্রথম মেসেজে লিখেছিলেন, "আমার পাশের তিনটি বাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমাদের সবাইকে এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে কিন্তু কোথায় যাব জানি না। আমরা শুধু অপেক্ষা করছি। আমার অনেক বন্ধু নিখোঁজ, হয়তো মারা গিয়েছে। এমনকি আমার বাবা-মায়ের কথাও জানি না।”
গতবছরের অক্টোবর মাসে ফরিদা তাঁর ছয় সন্তান আর ভাইবোনদের নিয়ে দক্ষিণ গাজার দিকে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে হাঁটছিলেন আর রাস্তাতেই ঘুমোচ্ছিলেন। তাঁরা ওয়াদী গাজার সেই অংশে যেতে চাইছিলেন, যেই অংশটা ইসরায়েল সুরক্ষিত বলে জানিয়েছিল। কিন্তু বেশ কিছু দিন রাস্তায় কাটানোর পর তাঁরা বুঝতে পারেন কোথাওই তাঁরা নিরাপদ নন। শেষপর্যন্ত উত্তর গাজায় পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। "আমরা দক্ষিণে থাকার কোনও জায়গা পাইনি। সামান্য প্রয়োজনের জিনিসও আমাদের কাছে ছিল না। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে ক্রমাগত বোমাবর্ষণ চলছিল। নিজেদের সম্মান রক্ষার খাতিরে অন্তত আমরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চারপাশে কী ঘটছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমাদের চারপাশে ক্রমাগত বোমাবর্ষণ হচ্ছে আর বাচ্চারা কেঁদেই চলেছে। কোথায় যাব আমরা জানি না। গাজায় রাতেও আপনি জানেন না পরদিন সকাল পর্যন্ত বাঁচবেন কি না। দিনে যদি চার-পাঁচ মিনিটও শান্তিতে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারি তাহলে আমরা খুবই খুশি হয়ে যাই। আমি এখন হিজাব পরে আমার পরিবারের সঙ্গে বসে আছি। আকাশপথে যে কোনও বোমা হামলার মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।” শেষবারের মত জানিয়েছিলেন ফরিদা। উত্তর গাজায় ফিরে আসার অল্প সময়ের মধ্যেই বোমা হামলায় তাদের বাড়ির একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধ্বংস হয়ে যায় রাস্তা।
যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগে আব্দেলহাকিম সফটওয়্যারে ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। যুদ্ধে তাঁদের আশ্রয়স্থল মধ্য গাজার আল বুরেইজ শরণার্থী শিবির। তিনি জানিয়েছেন, হাসপাতালে বিস্ফোরণের সময় তাঁর অনেক বন্ধু সেখানে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন আহত হন আর অন্যজনের পুরো পরিবার মারা যায়। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় রেকর্ড করা ভিডিওতে তিনি বলছিলেন, “আমার বয়স ২৩ বছর। আমি এখনও পর্যন্ত বেঁচে আছি। জানি না আমার কাহিনী প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকব কি না। যে কোনও সময়ে, আমি জঙ্গি বিমানের শিকার হতে পারি। আমরা সবাই বসে ছিলাম যখন হঠাৎ একটি রকেট বাড়িতে পড়ে। আশ্চর্যজনক ভাবে আমি এবং আমার পরিবার বেঁচে গেছি। আমরা অনেক কষ্টে বার হতে পারলেও আমাদের প্রতিবেশীরা এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন। আমরা তাদের খুঁজতে গিয়েছিলাম, কিন্তু কাউকে পাইনি। বাড়ির কিছু অংশ ঠিক করছি যাতে আমরা এখানে থাকতে পারি আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারি। প্রতি মিনিটে, প্রতি ঘন্টায় আমরা মৃত্যুর ঘেরাটোপের মধ্যে বেঁচে আছি। আমাদের কাছে জল নেই। ওষুধ, বিদ্যুৎ বা অন্য কোনও প্রয়োজনীয় জিনিস নেই। ভাই-বোনদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া এক টুকরো রুটি ছাড়া, আমি তিন দিন ধরে কিছুই খাইনি। গত ১২ দিনে আমি এবং আমার পরিবার ১০ ঘণ্টাও ঘুমাইনি। আমরা খুব ক্লান্ত। উদ্বেগের কারণে আমরা বিশ্রামও নিতে পারছি না। সাহায্যের জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। চারপাশে শরীরের টুকরো দেখে কেমন যেন স্থবির হয়ে গিয়েছিলাম। এখানে কেউ নিরাপদ নয়, আমরা সবাই শহীদ হতে চলেছি।"
মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও আব্দেল হাকিম সাহায্য করে চলেছেন অন্যদের। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে নিয়ে তাঁদের বাড়ি থেকে ত্রাণ বিতরণ করছেন। তিনি বলছেন, "আমরা ত্রাণ সামগ্রী এবং কম্বল প্রস্তুত করছি। শিশুরাও সাহায্য করছে। মিশর থেকে ট্রাক আসার জন্য অপেক্ষা না করে আমরা নিজেরাই উদ্যোগী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
খালিদ উত্তর গাজার জাবালিয়ায় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবারহ করেন। আকাশপথে বিলি করা সতর্ক-বার্তাবাহী প্রচারপত্র পাওয়ার পরও খালিদ কিন্তু তাঁর পরিবারের সঙ্গে অন্যত্র যেতে রাজি হননি। অক্টোবরে একটি ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছিলেন, “কোথায় যাব আমরা? কোনও স্থানই সুরক্ষিত নয়। সর্বত্র একই অবস্থা। যে কোনও পরিস্থিতিতেই আমরা মরব।” তিনি যখন মেসেজটি পাঠাচ্ছিলেন, পিছনে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। খালিদ তাঁর নিকট আত্মীয়ের দু’জন ছোট শিশুরও দেখাশোনা করেন। পাশের বাজারে হওয়া হামলায় বেঁচে গিয়েছিল ওই দু’জন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি চিকিৎসা সরঞ্জাম যে বিক্রি করতে পারছেন না, সে কথাও খালিদ জানিয়েছেন। “আহত মানুষের সংখ্যা বিপুল এবং সেই কারণে ওষুধের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কিছু ওষুধ কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, অথচ ওগুলো জরুরি ওষুধ ছিল।"
খালিদের সাথে শেষ যোগাযোগ হয়েছিল অক্টোবরে। সে জানিয়েছিল - “ওরা ক্রমাগত আমাদের উপর বোমাবর্ষণ করছে এবং আমরা জানি না কখন রুটি আনতে বাইরে যেতে পারব। খাবার সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজ নেই। আমরা নষ্ট খাবার,পচে যাওয়া টমেটো খাচ্ছি। ফুলকপি থেকে পোকামাকড় বেরিয়ে আসছে। এটি খাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই কারণ অন্য কিছুই নেই। পচে যাওয়া অংশগুলো ফেলে দিয়ে বাকিটাই খেতে হবে।" নিরুপায় ভাবে তার আর্তি ছিল "আমি যাচ্ছি না। এখন আমরা ভাবছি, হে আল্লাহ, পরবর্তী বোমা কখন পড়বে যাতে আমরা সবাই মরতে পারি এবং শান্তি পাই।" ৩১শে অক্টোবর তিনি যে অঞ্চলে থাকতেন, সেই জাবালিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর থেকে আর যোগাযোগ করা যায়নি তার সাথে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই হামলায় ১০১ জন নিহত ও ৩৮২ জন আহত হয়েছেন।
গাজার খান ইউনিসে বসবাসরত যুবক অ্যাডাম একদিনে পঞ্চমবারের মতো নিরাপদ স্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন নভেম্বরে। পেশায় শ্রমিক ওই যুবক বলেছিলেন, “গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে দক্ষিণে চলে যেতে বলা হয়েছে, বিশেষত খান ইউনিসে। তবে খান ইউনিসেও বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। একটা বোমা তো আমার বাড়ির কাছে পড়েছিল।” ইসরায়েল গাজাকে সম্পূর্ণ অবরোধ করার পর খাদ্য, ওষুধ ও পেট্রোল দ্রুত কমে এসেছে। পার্কিনসনস রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবার যত্ন নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলিও অ্যাডাম পাচ্ছেন না। এমনকি হাসপাতালেও কোনও শয্যা পাননি তিনি। আগের রাতে তাঁকে একটি হাসপাতাল চত্বরের মেঝেতে ঘুমোতে হয়েছিল। পরিবারের জন্য প্রতিদিন খাবার খোঁজার লড়াইয়ে শামিল অ্যাডাম বলেছেন, "লাইনে না দাঁড়িয়ে খাবার পেতে আমাকে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। যখন আপনাকে স্কুল প্রাঙ্গণে ঘুমোতে হয়, তখন আপনার ভিতরে একটা ভাঙন ধরে। যখন হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ঘুমোতে হয়, তখন আপনার ভেতরে কিছু একটা ভেঙ্গে যায় বৈকি। রুটির জন্য লাইনে দাঁড়ালে অথবা জলের জন্য কাকুতি মিনতি করার সময়ও তীব্র ভাঙন ধরে।” শেষ বার্তায় সে বলেছিল, “আমি আপনাদের এই পুরো ঘটনাটি জানিয়ে রাখতে চাই, যাতে এটা নথি হিসাবে থেকে যায়, যাতে বিশ্ব চিরকাল লজ্জা বোধ করে যে আমাদের সঙ্গে যা হল, তারা সেটা ঘটতে দিয়েছে।”
বছর পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধ চলছে। মিশর সংলগ্ন রাফাহ সীমান্তে ত্রাণবাহী ট্রাকগুলিকে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে যে পরিমাণ পণ্য আসছে তা গাজার বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৪ লাখেরও বেশি মানুষকে তাঁদের ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে। প্রথম চার সপ্তাহে ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। এর মধ্যে চার হাজারেরও বেশি শিশু।
ফরিদা, অ্যাডাম, খালিদ, আব্দেলহাকিম এখনো বেঁচে আছেন কি না, জানি না। এই নারীঘাতি, শিশুঘাতি যুদ্ধের শেষও অজানা। শুধু জানি, গল্প হয়ে থেকে যাবে ঘটনাগুলো। ফরিদার অপূরিত স্বপ্ন রয়ে যাবে আমাদেরই কারও বুকে। মুক্তির অবিচল লক্ষ্যে এগিয়ে চলা হাজার হাজার সেনানী একদিন জবাব চাইবে ঠিকই। শুরু হবে সব যুদ্ধের অবসানের যুদ্ধ। আকাশে সেদিন আর বিমানের কালো ধোঁয়া উড়বে না। নীল আকাশটা আরও নীল হয়ে যাবে তারপর থেকে।